‘হুন্ডি-স্বর্ণ’ গিলে খাচ্ছে প্রবাসী আয়

লোকমান হাকিম, ডেইলি কক্সবাজার •

 

  • দু’মাসে কক্সবাজারে এসেছে ২৬১ কোটি টাকা

  • সৌদি-দুবাইতে হুন্ডির টাকায় স্বর্ণ কারবারে বিনিয়োগ

  •  গত দু’বছরে প্রবাসে খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ 

গত তিন অর্থবছরের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কক্সবাজার জেলার প্রবাসী আয় নিম্নমুখী। জুলাই-আগস্টে প্রবাসীরা পাঠিয়েছে ২৩.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৬১ কোটি ২০ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। অথচ, ২০২৩ সালের প্রথম ছয়মাসে কক্সবাজার থেকে বৈধভাবে ১০ হাজার ৯২৭ জন বিদেশ গেছেন। যা গত বছরের দ্বিগুণ।

বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত প্রবাসীরা জানান, “করোনা পরবর্তী শ্রমিক ছাঁটাই, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির ফলে প্রবাসে খরচ বেড়েছে। এর বাইরে প্রবাসীদের অর্জিত মুদ্রা বেশি দামে কিনে স্বর্ণ কারবারে বিনিয়োগ করছেন চোরাচালান চক্র।”

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর জরিপ মতে, খোলা বাজারে ডলারের দাম বেশি পাওয়া এবং সময় বাঁচাতে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন না প্রবাসীরা। প্রায় ৬০ শতাংশই হুন্ডি কিংবা অবৈধ চ্যানেল বেছে নিচ্ছেন।

জেলার প্রবাসী-রেমিট্যান্সের-হালচাল :
বাংলাদেশ ব্যাংকের জেলাভিত্তিক প্রবাসী আয়ের তথ্যানুযায়ী, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে কক্সবাজার জেলায় রেমিট্যান্স এসেছিল ১৯৮.১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, পরের ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ১৭০.৮ মিলিয়ন, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে আসে ১৪৭.৯ মিলিয়ন। অন্যদিকে চলতি ২০২৩-২৪ অথবছরের প্রথম দুই মাসে এসেছে মাত্রা ২৩.৮ মিলিয়ন। এর মধ্যে জুলাইতে ১৪.৯ মিলিয়ন এবং আগস্টে এসেছে ৮.৯ মিলিয়ন।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুয়ায়ী, কক্সবাজার থেকে ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে বিদেশ গেছেন ১০ হাজার ৯২৭ জন। যা আগের বছরগুলোর চেয়ে তুলনামূলক বেশি। প্রতিষ্ঠানটির মতে, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ১২ হাজার ২২৫ জন, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ৩ হাজার ২০১ জন, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ১১ হাজার ৬৩২ জন এবং ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ৭ হাজার ৭৫৩ জন প্রবাসে গেছেন।

প্রবাসীদের বেড়েছে ব্যয় :
কক্সবাজার জেলার বেশির ভাগই প্রবাসীর প্রথম পছন্দ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব। এরপরে সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, মালয়েশিয়া, ওমান, বাহরাইন ও কুয়েত। বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে দেশগুলোতে দেড় লক্ষাধিক প্রবাসী রয়েছেন।

সৌদি প্রবাসী নুরুল আবছার বলেন, ‘দুবছর ধরে জিনিসপত্রের দাম উর্ধ্বমুখী। ১০০ রিয়ালের বাজার করলে ১৫% ভ্যাট নিচ্ছি সৌদি সরকার।’

মক্কায় অবস্থানরত রামুর আবদুল হামিদ বলেন, ‘কাজ না থাকায় অনেক শ্রমিক বেকার। তার ওপর প্রতিবছর ইকামা করতে ৫ হাজার থেকে ১৫ হাজার রিয়াল খরচ হচ্ছে। অনেক সময় ২-৩ হাজার রিয়াল বেশি দিয়েও ইকামা বাড়াচ্ছে না।’

সংযুক্ত আরব আমিরাতের দেরা দুবাইতে অবস্থানরত মহেশখালীর জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘গত ২-৩ বছরে কাজ কমার পাশাপাশি জনপ্রতি খরচ বেড়েছে ১৫-২০ হাজার টাকা। আগে ২৫-৩০ হাজার টাকায় চলতে পারতো। এখন লাগে ৪০-৪৫ হাজার টাকা।’
মালয়েশিয়া প্রবাসী সিরাজুল মোস্তফা বলেন, ‘৩-৪ বছর আগে শ্রমিক ছিল কম। এখন শ্রমিক বেশি, কাজ কম। করোনার পর থেকে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। খরচ পুষিয়ে টাকা পাঠাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রবাসীদের।’

আরেক প্রবাসী মনজুর আলম বলেন, ‘২ লাখ মানুষ কলিং এলেও দেড়লাখ এসেছে ট্যুরিস্টে। এজেন্সিগুলো কাজ দিতে না পারায় শ্রমিকেরা কয়েক মাস ধরে বেকার। যারা পুরাতন তাদের ২০০-২৫০ রিঙ্গিতে ব্যয় মিটতো। এখন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৪০০-৫০০ রিঙ্গিতে।’

মালয়েশিয়ায় প্রবাসীরা জানান, অনেক শ্রমিক ভিসা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে টাকা পাঠাতে পারছে না।এরই মধ্যে ভিসা রি-নিউ করতে ৪ হাজার রিঙ্গিত খরচ হচ্ছে তাদের। বিভিন্ন কোম্পানিতে নতুন শ্রমিক দেয়ায় পুরাতনদের ছাঁটাই করছে কতৃপক্ষ। নয়তো দৈনিক মজুরি ১০০ রিঙ্গিতের পরিবর্তে নেমেছে ৫০ রিঙ্গিতে।

হুন্ডি চক্রের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক :
বিদেশ থেকে যেকোনো ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতে চাইলে নির্ধারিত ব্যাংকে গিয়ে কারেন্সি জমা দিতে হয়। ওই কারেন্সির টাকা দেশের যেকোনো ব্যাংক থেকে তুলতে ৪-৫ দিন সময় লাগে। টাকা তোলার জন্য প্রবাসীর পরিবারকে যেতে হয় নির্ধারিত ব্যাংকে। এতে একদিকে সময়ক্ষেপণ হয়, অন্যদিকে সৃষ্টি হয় বিড়ম্বনার। ফলে প্রবাসীরা বেছে নিচ্ছেন অবৈধ পন্থা ।

মক্কায় অবস্থানরত কক্সবাজারের একাধিক প্রবাসী জানান, তারা মক্কায় যে এলাকায় থাকেন সেখানে বাংলাদেশি সরকারি কিংবা বেসরকারি একক ব্যাংকিং সেবা নেই। সৌদির ব্যাংকগুলো ১০০ রিয়ালে ১৫ শতাংশ চার্জ নেয়। এক বছরে ২০ হাজার রিয়ালের বেশি দেশে মুদ্রা দেশে পাঠাতে পারেন না তারা।

একাধিক সৌদি প্রবাসী জানান, ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে টাকা পাঠালে এক রিয়ালে (৩০ টাকা) চার্জ বাদ দিয়ে ২৯ টাকা পাই। অন্যদিকে হুন্ডিতে পাঠালে ৩১ টাকা পাওয়া যায়। পাশাপাশি ভোগান্তি নেই, সময়ও বাঁচে। দেশের এজেন্ট আমার ব্যাংক একাউন্ট টাকা পাঠিয়ে দেন বলে জানান প্রবাসীরা।

দুবাই’র ফুজাইরা সিটিতে অবস্থানরত কক্সবাজার শহরের বাসিন্দা বেলাল আহমদ বলেন, ‘ব্যাংকের মাধ্যমে ১ লাখ টাকায় ২৪ দিরহাম চার্জ কাটে। তবে সরকার লাখে ২.৫ শতাংশ প্রণোদনা দিলেও ব্যাংকে নানা ঝামলো পোহাতে হয়। ব্যাংকে টাকা পাঠালে প্রবাসীরা পায় ১ দিরহামে ৩০ টাকা ৯০ পয়সা পায়। হুন্ডিতে পাঠালে পাচ্ছে ৩১ টাকা ৯০ পয়সা।’

দুবাই প্রবাসী জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘ব্যাংকে ২ লাখ টাকার বেশি পাঠাতে গেলে নানান জবাবদিহি করতে হয়। এক সাথে ৫ লাখ টাকা পাঠালে পরবর্তী তিন মাস পাঠানো যায় না।’

মালয়েশিয়ার ক্লাং এলাকায় প্রবাসী রইসুল হাসান রিয়াদ বলেন, ‘আমি যে এলাকায় থাকি সেখানেই ১৫ জনের বেশি হুন্ডির এজেন্ট রয়েছে। এসবে বাংলাদেশিরাই ব্যবসায় জড়িত। নিয়ন্ত্রণ করে কুয়ালামপুর থেকে। এজেন্ট যদি এক রিঙ্গিতে ২৪ টাকা ৮০ পয়সা কিনে, এজেন্টদের কাছ থেকে বড় ব্যবসায়ীরা কিনে ২৪ টাকা ৯০ পয়সা।’

মহেশখালীর এক ওমান প্রবাসী নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ‘ওমানে অনেক বাংলাদেশি ব্যবসার আড়ালে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে জড়িত। দেশের বিভিন্ন স্থানেও তাদের এজেন্ট রয়েছে। আমি দু’বার টাকা পাঠাতে ব্যাংকে গিয়েছিলাম। কিন্তু কর্মস্থল থেকে দূরে হওয়ার আর যাইনি। এক এজেন্ট দেশ থেকেই আমার পরিবারে টাকা পাঠিয়ে দেয়।’

এ ব্যাপারে কক্সবাজার জনশক্তি ও কমসংস্থান অফিসের সহকারী পরিচালক লিটন চৌধুরী বলেন, ‘কক্সবাজার-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নিবন্ধিত হয়ে অনেকে বিদেশ যাচ্ছে। যারা বিদেশ যায়, তাদের তিন দিনের প্রশিক্ষণ দিই। প্রশিক্ষণে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর জন্য বলা হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স কমার বিষয়টি লক্ষ্য করছি, এটি উদ্বেগের।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘আমরা বৈধপথে রেমিট্যান্স আনার ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করছি। ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠানো নিরাপদ। পাশাপাশি অতিরিক্ত আড়াই শতাংশ প্রণোদনা পাওয়া যায়। হুন্ডিতে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে আমরা বিএফআইইউকে বলেছি। এ বিষয়ে তারা কঠোর অবস্থানে।’

সৌদি-দুবাইতে স্বর্ণ কারবারে বিনিয়োগ :
দেশে ও প্রবাসে হুন্ডি ব্যবসার বড় চাহিদা তৈরি করেছে অর্থ পাচারকারীরা। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা স্বর্ণ ব্যবসার জোগানদাতা। সৌদি প্রবাসীদের তথ্য মতে, জিদ্দা, মক্কা, রিয়াদ, দাম্মামে বড় বড় ব্যবসায়ীরা রিয়ালগুলো বেশি দামে কিনে নেন। যার অধিকাংশই স্বর্ণ ব্যবসায়ী।

অপরদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দেরা দুবাই স্বর্ণ কারবারের জন্য বেশ পরিচিত। সেখানেও বড় বড় ব্যবসায়ীরা রেট বেশি দিয়ে প্রবাসীদের থেকে দিরহাম কিনে নেন। এরপর বিনিয়োগ করেন স্বর্ণ ব্যবসায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সৌদি প্রবাসী বলেন, ‘সৌদিতে একটি স্বর্ণের বারের দাম ২৭ হাজার রিয়াল। দেশে আসার সময় একজন প্রবাসী দুটি বার নিয়ে আসতে পারেন। বিমানবন্দরে দুটির জন্য ৭০০ ডলার ভ্যাট দিতে হয়। সেগুলো দেশে বিক্রি করলে একটি বারে লাভ হয় ১ লক্ষ টাকার বেশি।’

প্রবাসীদের মতে, ‘স্বর্ণ কারবারিদের সাথে বিমানবন্দরে কর্মরত থাকা অনেকের সঙ্গে যোগসাজশ আছে। তারা ঘুষের বিনিময়ে অবৈধভাবে আসা বারগুলো ছেড়ে দেয়। এসব বন্ধ হলে রেমিট্যান্স আরো বাড়তো।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন দুবাই প্রবাসী বলেন, ‘দুবাইতে ঢাকা, চট্টগ্রামের পাশাপাশি কক্সবাজার জেলার চকরিয়ার বেশ কয়েকজন বড় সিন্ডিকেট আছে। তারা এজেন্টগুলোর কাছ থেকে দিরহামের আন্তর্জাতিক রেট অনুযায়ী এক টাকা বেশি দামে কিনে নেয়। অন্যদিকে দেশে থাকা এজেন্টগুলো কোনো ব্যাংক কিংবা এজেন্ট থেকে প্রবাসীদের পরিবারে টাকা পাঠিয়ে দেন। ফলে দেশের টাকা দেশেই ঘুরছে।’

তথ্য বলছে, বিনা শুল্কে একজন প্রবাসী দেশে আসার সময় ১০ ভরি স্বর্ণ, ১টি ল্যাপটপ, ২টি মোবাইল ও ১টি সিগারেটের বান্ডিল নিয়ে আসতে পারেন। তবে অনেকেই ল্যাপটপ ও বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স পণ্যে ঢুকিয়ে স্বর্ণ নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। বিনিময়ে বাহক পান ২৫ হাজার টাকা। গেল মাসে পাচারে জড়িত ১৫-২০ জন বাংলাদেশি ফুজাইরা বিমানবন্দরে আটক হওয়ার খবরও মিলেছে।

এদিকে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) হুন্ডি লেনদেন, চোরাচালান ও মোবাইল ব্যাংকিং সেবা এজেন্ট বাতিলসহ অনেকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে। বিএফআইইউর তদন্তে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কাজ করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

জানতে চাইলে চাইলে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের তদন্ত শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার বাছির উদ্দিন বলেন, ‘বিএফআইইউ থেকে অনেক তথ্য এসেছে। আমরা এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছি। সেগুলো তদন্ত করা হচ্ছে। সত্যতা পেলে মামলা এবং পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’